১৩ বছরের কিশোরী পারভীন সুলতানা (ছদ্মনাম)। ২০১৬ সালের অক্টোবরে বাবাকে হত্যা করে মিয়ানমার সৈন্যরা। এরপর রাখাইনের নাইসাপ্রু থেকে চাচা-চাচীর সাথে পালিয়ে এসে উখিয়ার একটি ভাড়া বাড়িতে আশ্রয় নেয়। কিছুদিন পর এইডস আক্রান্ত হয়ে তার মা মারা যায়। এরপর পারভীনেরও শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়। পরীক্ষার পর জানা যায় সে-ও এইচআইভি পজিটিভ। এরপর থেকে কক্সবাজারের বেসরকারি চিকিত্সা কেন্দ্র ‘আশার আলো সোসাইটি’তে চিকিত্সাধীন পারভীন।
এইডস ঝুঁকিতে কক্সবাজার – সস্তায় রোহিঙ্গাদের সেক্স এর জন্য ভাড়া করছে যুবকরা
পারভীন জানায়, তার বাবা শামসুল ইসলাম মধ্যপ্রাচ্যে ছিলেন। পারভীনের জন্মের আগে বাবার কাছ থেকে এইচআইভি’র জীবাণু ছড়ায় মা রহিমা আক্তারের শরীরে। ২০১২ সালে মিয়ানমার সহিংসতার সময় তারা প্রথম দফায় বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। সে সময় কিছুদিন রহিমা ‘আশার আলো সোসাইটি’তে চিকিত্সা নিয়ে আবার মিয়ানমারে ফিরে যান। এরপর ২০১৬’র অক্টোবরের সহিংসতায় বাবাকে হত্যা করা হলে তারা আবার পালিয়ে আসে। কিছুদিন পর মা-ও এইচআইভিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এরপর চিকিত্সা নিতে ভর্তি হয় পারভীন।
দেখে আসুনঃ কিভাবে অল্প বয়সী বিধবা মেয়েরা ছেলেদের গোপনে ডেকে সেক্স করছে
আশার আলো সোসাইটিতে পারভীনের বাসস্থান হিসেবে এখনো উল্লেখ আছে উখিয়ার ওই ভাড়া বাড়ি। তবে অনুসন্ধানে মিলেছে ভিন্ন তথ্য। কক্সবাজার শহরের একটি ভাড়া বাড়িতে ভাইকে নিয়ে থাকে পারভীন। আর জীবন চালাতে ইতোমধ্যে পতিতাবৃত্তিতে জড়িয়েছে সে। শরীর কেমন- জানতে চাইলে পারভীন বলে, ‘মাথা ঘোরায়, খানা খেতে পারি না, গা কাঁপে। ভয় ভয় লাগে।’
কক্সবাজার সদরের বিভিন্ন হোটেল ও শহরের কলাতলীস্থ সিংহভাগ কটেজ ও গেষ্ট হাউসে হোটেল ব্যবসার আড়ালে চলছে জমজমাট পতিতা ব্যবসা। থানা পুলিশ বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে পতিতা ও দালালদের আটক করেলেও কিছুতেই থামছে না এই পতিতা ব্যবসা। বিশেষ করে শহরের এন্ডারসন রোড়ের পাচঁতারাহোটেল,আহসান বোড়িং,সাতকানিয়া বোড়িং, ফায়ার সার্ভিস সংলগ্ন রাজমনি হোটেল,ঝাউতলা রোড়ের হোটেল সী-কুইন প্রা: লি: ও কলাতলীস্থ সিংহভাগ কটেজ ও গেষ্ট হাউসে রাত-দিন চলছে প্রকাশ্যে পতিতা ব্যবসা। দু’ সিফটে ভাগ করে এসব হোটেল গুলিতে চলে পতিতা ব্যবসা। দিনে চলে রেজিষ্টারবিহীন ঘন্টা ব্যাপী দেহ ব্যবসা আর রাত্রে চলে হোটেলে অবস্থারত বোর্ডারদের সিরিয়াল ভিত্তিক পতিতা ব্যবসা।
একই কেন্দ্রে চিকিত্সাধীন আরেকজন এইডস রোগী ৪৫ বছরের মো. সুলতান (ছদ্মনাম)। ২২ বছর আগে মিয়ানমার থেকে কক্সবাজারের রামুতে আসেন। এর মাঝে পাকিস্তান হয়ে সৌদি আরব গিয়েছিলেন। আর সেখান থেকে এইচআইভি’র জীবাণু নিয়ে বাংলাদেশে আসেন।
কিশোরী পারভীন কিংবা প্রাপ্তবয়স্ক সুলতানের মতো যেসব রোহিঙ্গা আগে থেকেই বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে এদের অনেকের শরীরেই এইচআইভি পজিটিভ পাওয়া গেছে। কক্সাবাজার সদর হাসপাতালের চিকিত্সকরা জানিয়েছেন, এর আগেও মিয়ানমার থেকে বিভিন্ন সময়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে এইডস রোগী পাওয়া গেছে। আর নতুন করে যারা পালিয়ে আসছেন তাদের মধ্যে এ পর্যন্ত ২৭ জন এইডস রোগী শনাক্ত হয়েছে। এদের মধ্যে ১৬ জন নারী ও ১১ জন পুরুষ। ইতোমধ্যে এইডস আক্রান্ত মরিয়ম বেগম (৫৫) নামের এক নারীর মৃত্যু হয়েছে।
বিভিন্ন পতিতা ব্যবসায়ী ও দালালরা মোট অংকের টাকার লোভ দেখিয়ে উঠতি বয়সের রোহিঙ্গা তরুণীদের সংগ্রহ করে তাদের সাথে আতাত হওয়া পর্যটন নগরী কক্সবাজারের তালিকাভুক্ত হোটেলগুলিতে পতিতা সরবরাহ করে থাকে অনেক সময় তারা স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিয়ে রুম নিয়ে রাত্রে হোটেলে অবস্থারত বোর্ডারদের বিভিন্ন রুমে মোটা টাকার বিনিময়ে এসব রোহিঙ্গা তরুনীদের ঘন্টা ও সারা রাত্রের জন্য ভাড়া দেয়। আর এসব দালালদের সাথে হোটেল কর্তৃপক্ষের রয়েছে গোপন আতাত। ঢাকা থেকে আসা করিম নামের এক দালাল জানান,আমরা হোটেল কর্তৃপক্ষের গ্রীণ সিগনাল পেলে তার পর আমরা এসব হোটেলে রোহিঙ্গা পতিতা নিয়ে আসি এবং সরবরাহ করে থাকি। তবে রোহিঙ্গা পতিতাদের উপার্জিত সিংহ ভাগ টাকা হোটেল কর্তৃপক্ষ নিয়ে নেন বলে তিনি জানান।
দেখে নিনঃ কক্সবাজার হোটেল এর ফোন নাম্বার
কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিত্সক শানীন আবদুর রহমান চৌধুরী জানিয়েছেন, প্রতিবেশী মিয়ানমারে প্রতি ১ হাজার জনে ৮ জনের এইচআইভি পজিটিভ বলে ধরা হয়। সেই হিসেবে বাংলাদেশে যে পরিমাণ রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছে তাদের মধ্যে অন্তত ৪ হাজার এইডস রোগী থাকতে পারে। তবে এই সংখ্যা কিছুটা কমবেশি হতে পারে বলে তিনি জানান ।
রোহিঙ্গা পল্লীগুলো যেনো এখন যৌনপল্লী হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। পল্লীতে দিনেও রাতে বিভিন্ন লোকজনের আনাগুনা দেখা গেলেও পল্লীতে রাতে চলে রোহিঙ্গা নারীদের ফুর্তি ও মাদকের আসর।
জানা গেছে, ২০১২ সাল থেকে চলতি বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কক্সবাজারে ১৬৭ জন এইডস রোগী পাওয়া গেছে। ৫৪ জনই রোহিঙ্গা। এদের মধ্যে ৪২ জনের মৃত্যু হয়েছে। বাকিরা কক্সবাজার, চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে দীর্ঘমেয়াদী চিকিত্সা নিচ্ছেন।
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা নারী হালিমা (২১) জানিয়েছে, বাংলাদেশে এসে কীভাবে তিনি পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য হলেন। বাংলাদেশে প্রবেশের পর আমাদের একটি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে স্থানীয় এক বাংলাদেশি পুরুষ আমাদের কিছু খাবার দেয়। তিনি তার স্ত্রীকে হারিয়েছে ও তার দুই শিশু সন্তান রয়েছে বলে আমাকে জানান। তিনি আমাকে বিয়ে করতে চান, বলেও জানান।হালিমা সেই ব্যক্তির কথায় বিশ্বাস করে কক্সবাজারে তার বাসায় যান।আমি যখন বাসায় ঢুকি, সেখানে আমার মতো ৭-৮ জন তরুণীকে দেখি। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। সেই বাসায় সে আমাকে অনেক পুরুষের সাথে সেক্স করতে বাধ্য করে।
জাতিসংঘের এইডস বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইউএনএইডসের সর্বশেষ তথ্যমতে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মিয়ানমার এইচআইভি-এইডস রোগের দিক থেকে চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। দেশটিতে আড়াই লাখের বেশি এইডস রোগী আছে। মোট জনসংখ্যার প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে দশমিক ৮ ভাগ এইডস আক্রান্ত। সেখানে ইনজেকশন সিরিঞ্জের মাধ্যমে এইডস সংক্রমিত হয়েছে ২৩ ভাগ আক্রান্তের শরীরে, নারী যৌনকর্মীদের মধ্যে ৬ দশমিক ৩ ভাগ এবং সমকামীদের মধ্যে ৬ দশমিক ৬ ভাগ এইডস আক্রান্ত। এছাড়া রাখাইন প্রদেশে প্রচুর প্রবাসী বিদেশ থেকে এইডস এর জীবাণু বহন করেন। তাদের মাধ্যমে তাদের স্ত্রী এবং সন্তানের শরীরেও এইডস ছড়িয়ে পড়ে।
কক্সবাজার সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে তাদের মধ্যে ২ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে বিভিন্ন ধরনের চিকিত্সা সেবা দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার ও বিভিন্ন সাহায্য সংস্থার মেডিক্যাল টিম। এদের মধ্যে প্রাণঘাতী হাম, পোলিওসহ এইডস রোগীর সন্ধানও পাওয়া গেছে।
টেকনাফ-উখিয়ার রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে কাজ করছেন এমন বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক জানিয়েছেন, রোহিঙ্গারা একেবারেই স্বাস্থ্য সচেতন নয়। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক এইডস রোগী শনাক্ত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগও উদ্বিগ্ন। ইতোমধ্যে টেকনাফ ও উখিয়ায় এইচআইভি পরীক্ষার জন্য দুটি ল্যাবরেটরিও স্থাপন করা হয়েছে। তবে রোহিঙ্গা শিবিরের অন্যান্য দিকের ব্যস্ততায় এইচআইভি পরীক্ষা দ্রুতগতিতে করা যাচ্ছে না। দ্রুত তাদের চিহূিত করে নিয়ন্ত্রিত স্থানে রেখে চিকিত্সা সেবা দিতে না পারলে পুরো চট্টগ্রাম এমনকি দেশের অন্যপ্রান্তেও এই রোগ ছড়াতে পারে বলে তাদের আশঙ্কা।
টেকনাফ সরকারি কলেজের প্রভাষক আবু তাহের বলেন, আগে থেকে আসা এবং নতুন করে আসা রোহিঙ্গা কিশোরী ও তরুণীদের অনেকে যৌনকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। এ ছাড়া আইন করেও রোহিঙ্গাদের সাথে স্থানীয়দের বিয়ে বন্ধ করা যায়নি। আবার অনেক রোহিঙ্গা পরিবার প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে কক্সবাজার, চট্টগ্রামের দিকেও ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে সচেতন বা অবচেতনভাবে এ সব রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে এইডস ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।
দারিদ্র্যপীড়িত সাড়ে তিন লাখ রোহিঙ্গা শিশু
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ৩ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা শিশু দারিদ্র্যপীড়িত। তারা পর্যাপ্ত খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও চিকিত্সা সেবার অভাবে মানবেতর দিন কাটাচ্ছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ। খবর রয়টার্সের।
ইউনিসেফের কর্মকর্তা সিমন ইনগ্রামের উদ্ধৃতি দিয়ে বার্তা সংস্থাটি তাদের প্রতিবেদনে জানায়, বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থান নেওয়া পাঁচ বছর বয়সের নিচে প্রতি পাঁচজন শিশুর মধ্যে একজন তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে। তাদের চিকিত্সা সেবা প্রয়োজন। সেখানে ডায়রিয়া, কলেরাসহ অন্যান্য পানিবাহিত রোগের ঝুঁকি খুবই বেশি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সপ্তাহে গড়ে ১২ হাজার শিশু ক্যাম্পে আশ্রয় নিচ্ছে। ক্ষুধা ও সহিংসতা থেকে পালিয়ে আসা এ সব শিশুরা এখনো মানসিক বৈকল্য কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ইউনিসেফ তাদের বিশুদ্ধ পানি ও টয়লেটের ব্যবস্থা করেছে এবং কলেরার টিকা দিচ্ছে। রোহিঙ্গা শিশুদের সহায়তায় ৭৬ মিলিয়ন ডলার চেয়েছে ইউনিসেফ। কিন্তু মাত্র ৭ শতাংশ পাওয়া গেছে।
ইউনিসেফের ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, এই সংকট স্বল্পমেয়াদী নয় এবং খুব সহসাই এর সমাধান হবে বলে মনে হয় না। তাই তাদের জন্য বাংলাদেশি শিশুদের মতো সকল সুবিধা নিশ্চিত করা হবে খুবই কঠিন কাজ।
প্রসঙ্গত, গত ২৫ আগস্ট রাখাইনে সহিংসতার পর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের উপর ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞ’ শুরু করে। জীবন বাঁচাতে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গা। এদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু।
nice