World Cancer Research Fund International এর একটি পরিসংখ্যাণ অনুযায়ী ২০১২ সালে প্রোস্টেট ক্যান্সারে ১১ লাখেরও বেশি কেস নথিভূক্ত হয়েছে, যা সকল ধরণের নতুন ক্যান্সার সেসের ৮% ভাগ। তবে প্রোস্টেট ক্যান্সার সফলভাবে চিকিত্সা করা সম্ভব এবং বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ পুরুষ প্রোস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার পরও সফলভাবে চিকিত্সার পর বেচে আছেন।
প্রোস্টেট কি? What is Prostate?
প্রোস্টেট হলো শ্রোণীচক্রের ভিতরের একটি ছোট গন্থি যা শুধুমাত্র পুরুষদেরই থাকে। আখরোট আকারের এই গ্রন্থি পুরুষাঙ্গ ও মূত্রাশয়ের মধ্যে অবস্থান করে। এটি ইউরেথ্রা বা মূত্রনালী ঘিরে থাকে, যা মূত্রাশয় থেকে পুরুষাঙ্গে মূত্র বহণকারী একটি টিউব বা নল। প্রোস্টেটের প্রধান কাজ হচ্ছে বীয্য উত্পাদনে সাহায্য করা। প্রোস্টেট থেকে এক ধরণের ঘন সাদা তরল পদার্থ তৈরি হয় যা টেস্টিকলে (Testicles) (শুক্রাশয়) উত্পন্ন স্পার্ম (শুক্রাণু)-এর সাথে যুক্ত হয়ে বীয্য সৃষ্টি করে।
প্রোস্টেট ক্যান্সারের প্রধান লক্ষণসমূহ (Signs Of Prostate Cancer)
প্রোস্টেট ক্যান্সার ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে, তাই আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও কয়েক বছর পর্যন্ত রোগী কোন ধরণের লক্ষণ অনুভব নাও করতে পারে। প্রোস্টেট যখন যথেষ্ট বড় হয়ে মূত্রনালীকে (মূত্রাশয় থেকে মূত্র বহনকারী নল) আক্রান্ত করে, শুধুমাত্র তখনই লক্ষণসমূহ প্রকাশ পেয়ে থাকে। এমতাবস্থায় নিম্মোক্ত বিষয়গুলো রোগীর দৃষ্টিগোচর হতে পারে। যেমন-
- ঘন ঘন বিশেষ করে রাতের বেলা বেশিবার প্রস্রাব হওয়া, প্রস্রাবের বেগ হলে আটকে রাখতে কষ্ট হওয়া, প্রস্রাব শেষ করতে বেশি সময় লাগা, মূত্র ত্যাগের শুরুতে প্রস্রাব আসতে দেরী হওয়া, প্রস্রাবের দুর্বল প্রবাহ, মূত্রাশয় সম্পূর্ণরূপে খালি হয়নি এমন অনুভব হওয়া ইত্যাদি।
তবে এসব লক্ষণ দেখা দিলে সব সময়ই যে তা প্রোস্টেট ক্যান্সারের কারণে হবে এমন ধারণাও ঠিক নয়। লক্ষণগুলো অন্যান্য রোগ যেমন বিনাইন প্রোস্টেটিক হাইপারপ্লাসিয়া (Benign Prostatic Hyperplasia) (প্রোস্টেট বড় হয়ে যাওয়া)-এর কারণেও হতে পারে।
প্রোস্টেট ক্যান্সার কেন হয় – Why Prostate Cancer Occurs?
প্রোস্টেট ক্যান্সারের কারণ এখনও অজানা। তবে কয়েকটি বিষয় আছে যা এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি করতে পারে। যেমন-
- সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গেছে যে স্থূলতা বা অতিরিক্ত ওজন প্রোস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সাথে সম্পর্কিত।
- পারিবারিক ইতিহাস- ভাই, বাবা অথবা চাচার মত নিকটাত্মীয়দের মধ্যে কারো অতিতে প্রোস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে থাকলে, এ রোগে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি বেশি থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে যে কোন নিকট মহিলা আত্মীয় স্তনের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে থাকলে তা আপনাকে প্রোস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রাখবে।
- বয়স- বয়স বৃদ্ধি অর্থ্যাত্ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ৫০ বছরের অধিক বয়সী পুরষদের মধ্যে এ রোগ ধরা পড়ে বেশি।
- নিয়মিত ব্যায়াম বা শারীরিক চর্চা অনুশীলনকারী ব্যক্তিরা প্রোস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার কম ঝুঁকিতে থাকেন।
- প্রোস্টেট ক্যান্সার ও খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে সম্পর্ক নিরুপনের গবেষণা বর্তমানে চলছে। গবেষণায় প্রতিয়মান হয়েছে উচ্চ ক্যালসিয়ামযুক্ত খাদ্য প্রোস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। সেই সাথে কিছু কিছু গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে যেসব পুরুষ নির্দিষ্ট পুষ্টি উপাদান, যেমন-লাইকোপিন, সেলেনিয়ামযুক্ত খাবার খেয়ে থাকেন, তারা প্রোস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার কম ঝুঁকিতে থাকেন। টমেটো সহ অন্যান্য লাল ফলে লাইকোপিন এবং ব্রাজিলিয়ান বাদামে সেলেনিয়াম থাকে।
প্রোস্টেট ক্যান্সার নির্ণয়ের পরীক্ষাসমূহ – Examination to Detect Prostate Cancer
প্রোস্টেট ক্যান্সার নির্ণয়ের জন্য একক কোন পরীক্ষা নেই। এই রোগ নির্ণয়ের জন্য পরিচালিত পরীক্ষাগুলোর উপকারিতা এবং ঝুঁকি উভয়ই আছে, যা সম্পর্কে ডাক্তার আপনার সাথে আলোচনা করবেন। প্রোস্টেট ক্যান্সার নির্ণয়ের জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহূত পরীক্ষাগুলো হলো-
১. সংক্রমণ আছে কিনা তা দেখার জন্য মূত্রের পরীক্ষা
২. রক্ত প্রোস্টেট স্পেসিফিক এন্টিজেনের মাত্রা নির্ণয়ের পরীক্ষা।
৩. পায়ুপথে প্রোস্টেট পরীক্ষা।
প্রোস্টেট স্পেসিফিক এন্টিজেন (PSA) পরীক্ষায় রক্তে এর উপস্থিতির মাত্রা পরিমাপ করা হয় এবং এ পরীক্ষা দ্বারা প্রাথমিক অবস্থায় প্রোস্টেট ক্যান্সার নির্ণয় করা যেতে পারে। পুরুষদেরকে নিয়মিতভাবে PSA পরীক্ষা করার পরামর্শ দেয়া হয় না, কেননা এর ফলাফল সবর্দা নির্ভরযোগ্য হয়না। প্রোস্টেট ক্যান্সারের পাশাপাশি অন্যান্য কিছু রোগেও যেমন-ক্যান্সার বিহীনভাবে প্রোস্টেট বৃদ্ধি (BPH), মূত্রনালীর সংক্রামণ বা প্রোস্টেট প্রদাহের কারণেও পিএসএ’এর মাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে। পিএসএ-এর মাত্রা উচ্চ থাকলে তা জীবনের জন্য হুমকি স্বরুপ প্রোস্টেট ক্যান্সার সৃষ্টি করবে কিনা সে সম্পর্কেও নিশ্চিতভাবে এখনও জানা যায়নি। তাই উচ্চ বিএসএ’র মাত্রা নির্ণয়ের পরীক্ষা অনেক সময় অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিত্সার জন্য দেয়। প্রোস্টেট ক্যান্সারের চিকিত্সা
প্রোস্টেট ক্যান্সারের চিকিত্সা সব ক্ষেত্রে খুব দ্রুত শুরু করার প্রয়োজন হয় না। যদি ক্যান্সার প্রথমিক পর্যায়ে থাকে এবং লক্ষণ বা উপসর্গ প্রকাশিত না হয়, তবে চিকিত্সা শুরু না করে সাবধানতার সাথে আপনার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা হয়ে থাকে। কিছু ক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিত্সার মাধ্যমে আরোগ্য লাভ করা যায়। চিকিত্সা পদ্ধতিগুলো হল সার্জারির মাধ্যমে প্রোস্টেট অপসারণ, রেডিওথেরাপি ও হরমোন থেরাপি। কয়েকটি ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ক্যান্সার ছড়িয়ে পরার পর চিকিত্সা প্রদান করা হয়। যদি ক্যান্সার শরীরের অন্যান্য অংশে, বিশেষ করে হাড়ে ছড়িয়ে পরে তাহলে তা নিরাময় করা যায় না এবং আয়ু বৃদ্ধি ও উপসর্গ নিরাময়ের লক্ষ্যে চিকিত্সা প্রদান করা হয়। সব ধরণের চিকিত্সায় উল্লেখযোগ্য পার্শ্ব-পতিক্রিয়ার ঝুঁকি থাকে, যেমন-পুরুষাঙ্গের উত্থান জনিত সমস্যা, প্রস্রাবের বেগ ধরে রাখতে না পারা প্রভৃতি। এ কারণে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত অনেক ব্যক্তি চিকিত্সা গ্রহণে বিলম্ব করে থাকেন।
প্রোস্টেট ক্যান্সার নিয়ে জীবন ধারণ – Live With Prostate Cancer
যেহেতু প্রোস্টেট ক্যান্সার ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়, তাই অনেক বছর পর্যন্ত লক্ষণ প্রকাশিত নাও হতে পারে এবং চিকিত্সা গ্রহণের প্রয়োজন দেখা দেয় না। তা সত্বেও এটি জীবনের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। পুরুষাঙ্গের উত্থান জনিত সমস্যা, প্রস্রাবের বেগ ধরে রাখতে না পারা প্রভৃতি শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি ক্যান্সারের চিকিত্সা গ্রহণের কারণে আপনি দুশ্চিন্তা বা বিষন্নতায় ভূগতে পারেন। পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, পারিবারিক ডাক্তার এবং প্রোস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত অন্যান্য ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে আপনি উপকার পেতে পারেন।
Discover more from Health Bangla
Subscribe to get the latest posts sent to your email.