শীতে অনেকেরই নাক কান গলা তে সমস্যা দেখা দেয়। শীতের সময় এই রোগগুলো সম্পর্কে জানা না থাকার জন্য খুব সহজেই একজন আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারেন। আজ জেনে নিন শীতে আমাদের নাক কান গলার কি কি সমস্যা হতে পারে।
এর আগে গত কয়েক বছর আমরা লিখেছিলাম শীতকালে নাক কান গলার রোগ এটি দেখে নিতে পারেন এখানে শীতে নাক কান গলার রোগ।
শীতকালে কিছু অসুখের মাত্রা বাড়ে। এর মধ্যে নাক, কান ও গলার অসুখগুলো অন্যতম। কিছু সতর্ক পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিলে ভালো থাকা যায়। পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ ইএনটি হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আবদুল্লাহ।
শীতকালে নাক কান গলার সমস্যা
সর্দি-কাশি
শীতের কমন সমস্যা সর্দি-কাশি। মূলত শীতকালে অতিরিক্ত ঠাণ্ডার ফলে সর্দির সৃষ্টি হয়। অনেক সময় সর্দি লাগলে কানে ব্যথা হয় এবং নাক দিয়ে ঘন হলুদ কফ ও রক্ত পড়ে। তা ছাড়া এই সময়ে কাশির প্রকোপও বেড়ে যায়। ফলে বুকে ও গলায় ব্যথা দেখা দেয়। অতিরিক্ত কাশির ফলে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। অনেক সময় কাশির সঙ্গে কফ বা রক্তও বের হতে পারে। হাঁপানি, অ্যালার্জি বা সাইনোসাইটিস না থাকলেও এমনটি ঘটতে পারে। এ ক্ষেত্রে কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। অনেক সময় কাশি এমনিতেই সেরে যায়।
সর্দি-কাশির ফলে নাক একেবারে বন্ধ হয়ে গেলে বাজারে প্রচলিত নেজাল ড্রপে উপকার মেলে। এ ছাড়া বড় একটি পাত্রে ফুটন্ত পানি ঢেলে, তাতে মেন্থল দিয়ে মুখ নিচু করে রেখে কয়েক মিনিট সেই পানির ভাপ নিলে নাক খুলে যায়। দিনে কয়েকবার এই ভাপ নেওয়া যায়।
অ্যান্টিহিস্টামিন -জাতীয় ওষুধেও কাজ হয়।
এ ছাড়া কিছু ঘরোয়া দাওয়াই সর্দি-কাশির সমস্যায় ভালো রাখতে পারে। যেমন—সব সময় কুসুম গরম পানি পান করা, হালকা গরম পানিতে মধু ও লেবুর রস মিশিয়ে পান করা, চায়ের সঙ্গে তুলসীপাতা জ্বাল দিয়ে খাওয়া বা মধুর সঙ্গে তুলসীপাতার রস খাওয়া, সরিষার তেল, পেঁয়াজ ও কাঁচা মরিচের ভর্তা, সরিষার ভর্তা, সরিষাশাক, কালিজিরার ভর্তা ইত্যাদিতে সর্দি-কাশি কমায়। এ ছাড়া শীতে গরম স্যুপ, গরম চা ঠাণ্ডা দূর করতে সাহায্য করে। পাশাপাশি দরকার প্রচুর পানি পান করা। কেননা সর্দি-কাশি ও জ্বরে শরীর দ্রুত পানিশূন্য হয়ে পড়ে।
মনে রাখতে হবে, নির্দিষ্ট সময় পর আপনা-আপনি কাশি ভালো হয়ে যায়।
তবে কাশির সঙ্গে জ্বর হলে গুরুত্ব দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াই শ্রেয়। দীর্ঘস্থায়ী কাশির ক্ষেত্রে প্রথমেই খুঁজে বের করতে হবে কাশির অন্তর্নিহিত কারণ।
টনসিলাইটিস
মুখগহ্বরের পেছনে, জিহ্বার দুই পাশে লাল মাংসপিণ্ডের মতো দেখা যায়, যাকে টনসিল বলে। এটি একটি লিম্ফোয়েড টিস্যু, যা মুখ গহ্বরের দিকে অবস্থান করে। টনসিলকে রোগ প্রতিরোধের রক্ষক হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু এই টনসিল যখন নিজেই অসুস্থ হয়, তখন আর রক্ষক হিসেবে কাজ করে না। বেশ সমস্যাই তৈরি করে। শিশুদের ক্ষেত্রেই এই সমস্যা বেশি দেখা যায়, যাদের টনসিল বড় অবস্থায় থাকে। যখন টনসিল লাল হয়ে ফুলে প্রদাহ সৃষ্টি করে, ইনফেকশন হয়, তখন তাকে টনসিলাইটিস বা টনসিলের প্রদাহ বলে। শীতকালে এই সমস্যাটি বেশি দেখা দেয়, বিশেষ করে শিশুদের বেলায়।
টনসিলাইটিসের সাধারণ উপসর্গ হলো—কোনো কিছু গিললে গলা ব্যথা করা, খেতে না চাওয়া, জ্বর জ্বর ভাব বা প্রচণ্ড জ্বর ইত্যাদি। অনেক সময় শিশুরা স্কুলে যেতে চায় না, মেজাজ রুক্ষ হয়, খেলাধুলা করতে চায় না বা কর্মক্ষমতা প্রদর্শন করে না ইত্যাদি।
টনসিলে ইনফেকশন হলে কিছু ক্ষেত্রে প্যারাসিটামল-জাতীয় ওষুধ খেলেই কাজ করে। তবে সহনীয় গরম পানির সঙ্গে কিছুটা লবণ মিশিয়ে অথবা এন্টিসেপটিক গারগল করলে বেশ আরাম পাওয়া যায়। ছোট শিশুরা গড়গড়া করতে পারে না, সে ক্ষেত্রে চিকিৎসক দেখানো উচিত। সতর্কতা হিসেবে সব সময় গলায় গরম কাপড় বা মাফলার ব্যবহার করা ভালো। ঠাণ্ডা পরিবেশ বা ঠাণ্ডা খাবার সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলতে হবে।
আইসক্রিম একেবারে নয়। বারবার ঘাম মুছে দিতে হবে ও ভেজা কাপড় যেন গায়ে বেশিক্ষণ না থাকে। বড়দের ক্ষেত্রেও ভালো না হলে চিকিৎসকের পরামর্শে অ্যান্টিবায়োটিক খেতে হতে পারে। শীতে যাদের টনসিলের সমস্যা দেখা দেয়, অ্যান্টিবায়োটিক খেয়েও যাদের সমস্যা দূর হয় না, তাদের টনসিল অপারেশন করাই যুক্তিযুক্ত।
এডিনয়েড
শিশুদের নাকের পেছনে এক ধরনের টনসিল থাকে, যাকে এডিনয়েড বলা হয়। এই এডিনয়েড বড় হয়ে গেলে নাক বন্ধ হয়ে যায়। তখন নাক দিয়ে নিঃশ্বাস নেওয়া কষ্টকর হয়। তাই রাতে অনেক শিশু মুখ হাঁ করে নিঃশ্বাস নেয়। এডিনয়েড অতিরিক্ত বড় হয়ে গেলে শিশুদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে এবং রাতে ঘুমের সময় নাক ডাকে। এতে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হতে পারে।
এডিনয়েডের কারণে শিশুদের মধ্যকর্ণে পানিও জমে যেতে পারে ও কানে বারবার ইনফেকশন হতে পারে। তখন শিশুরা কম শুনতে পায়। পড়ালেখায় অমনোযোগী হয়ে পড়ে এবং কানে কম শুনতে পায় বলে রেডিও-টেলিভিশনের ভলিউম বাড়িয়ে দেয়। এ ধরনের সমস্যা হলে নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করা হলে রোগটি জটিল হয়ে উঠতে পারে।
সাইনোসাইটিস
শীতকালে নাকের দুই পাশের সাইনাসে ইনফেকশন দেখা দেয়, একে বলে সাইনোসাইটিস। কারো সাইনোসাইটিস দেখা দিলে নাকের দুই পাশে ব্যথা ও মাথা ব্যথা হতে পারে। অ্যালার্জি, ঠাণ্ডা এবং ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো সমস্যাগুলো থেকে এই রোগের প্রকোপ দেখা দেয়। সাইনাসের এক্স-রে করলে রোগ নির্ণয় করা যায়। এরপর ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা করা যায়। সাইনোসাইটিসের ব্যথা মূলত কোন ধরনের সাইনাসে আক্রান্ত হয়েছে, তার ওপর অনেকাংশ নির্ভর করে। দীর্ঘমেয়াদি সাইনাস প্রদাহে ওয়াশ এবং শেষ পর্যায়ে সাইনাস সার্জারি করার প্রয়োজন হতে পারে। তাই প্রাথমিক পর্যায়ে সাইনোসাইটিসে আক্রান্ত হওয়ার আগেই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা নেওয়া ভালো।
কারো যদি অ্যালার্জি থাকে, সে ক্ষেত্রে জেনে নিতে হবে অ্যালার্জির কারণ। যাতে সতর্ক হয়ে তিনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। পাশাপাশি ধূমায়িত এবং দূষিত পরিবেশ পরিত্যাগ করে চলা, ধূমপান পরিত্যাগ করা, ঘুমানোর সময় মাথা উঁচু রাখা (যাতে সাইনাস নিজে থেকেই পরিষ্কার হতে পারে), নাকে খুব জোরে আঘাত লাগতে না দেওয়া ইত্যাদি বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।
স্বর বসে যাওয়া
গলার স্বর বসে যাওয়া বা গলা দিয়ে কথা বা স্বর বের না হওয়া—এমন সমস্যা হতে পারে এই শীতে। এ সমস্যাগুলো নাকের সমস্যার পর হতে পারে অথবা সরাসরি হতে পারে। এগুলো শীতে বৃদ্ধি পায় অথবা বেশি শীতের প্রকোপে শুরু হতে পারে। এ জন্য ঠাণ্ডা এড়িয়ে চলা, লবণ গরম পানি দিয়ে নাক পরিষ্কার করা, লবণ গরম পানি দিয়ে গড়গড়া করা এবং গরম ভাপ নেওয়া, গরম পানি পান করা ইত্যাদি নিয়ম মেনে চললে অনেক সময় প্রাথমিক পর্যায়ে এ সমস্যাগুলোর সমাধান হয়। মনে রাখতে হবে, গলার স্বর বসে যাওয়ার সর্বশেষ চিকিৎসা হলো কথা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া।
আমরা অনেক সময় কথা বন্ধের নামে ফিসফিস করে কথা বলি, যা আসলে আরো খারাপ পরিণতি ডেকে আনে। গলার স্বরযন্ত্রের জন্য কথা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হবে। ফিসফিস করেও কথা বলা যাবে না। কয়েক দিন কথা বন্ধ রাখার পর গলার স্বর যদি সম্পূর্ণ ফেরত না আসে, তবে অবশ্যই চিকিৎসক দেখিয়ে গলার স্বরযন্ত্রটি পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে। গলার স্বরযন্ত্রের চিকিৎসার সঙ্গে সঙ্গে আনুষঙ্গিক যে সমস্যা গলায় বা নাকে আছে, সে সমস্যাগুলোর দিকেও নজর দেওয়া বা সেগুলোর চিকিৎসা করার দরকার আছে।
গলা খুসখুস করা
একে বলে ক্রনিক ফ্যারিংজাইটিস বা গলায় প্রদাহ। গলার পেছনের দিকে অবস্থিত ফ্যারিংস নামের অংশের ইনফ্লামেশনকে ফ্যারিংজাইটিস বলে। এর কারণে সাধারণত ব্যথা ও ঘায়ের সৃষ্টি হতে পারে। অন্যান্য সমস্যার মতো এটাও ক্রনিক বা অ্যাকিউট হয়ে থাকে। এর ফলে টনসিল আক্রান্ত হতে পারে এবং আক্রান্ত ব্যক্তির খাবার গিলতে এবং ঢোক গিলতে অসুবিধা হয়। এর প্রধান উপসর্গগুলো হলো—গলা খুসখুস করা, গলা ব্যথা ও কাশি হওয়া, ঘুমের মধ্যে দম বন্ধ হয়ে আসা, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি। অনেক সময় প্রচণ্ড কাশি হয়, তবে কাশি সাধারণত শুকনো থাকে।
গরম ভাপ নিলে বা গড়গড়া করলে এবং ঠাণ্ডা এড়িয়ে চললে এ সমস্যায় উপকার পাওয়া যায়। এ জন্য উষ্ণ ও শুষ্ক পরিবেশে বসবাস করা, ঘরের মধ্যে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস প্রবেশ করানো, ঘরের মধ্যে জমা ধুলাবালি, বিশেষ করে লেপ-তোশক, কম্বল, পুরনো বই, কার্পেট, মখমলের সোফা, কাপড়চোপড় ভারী পর্দা—এগুলো সরিয়ে ফেলা অথবা এগুলোকে সপ্তাহে দুই-তিনবার সকাল-সন্ধ্যা রোদে দেওয়া উচিত। পাশাপাশি এয়ারকন্ডিশন, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ধূমপান এড়িয়ে চলা উচিত।
এই রোগের জন্য কিছু ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে। যেমন—গরম লবণ পানি দিয়ে গড়গড়া করা, গরম পানীয় (যেমন—ক্যাফেইন ছাড়া চা, মধু মেশানো পানি, গরম স্যুপ) পান করা, পানিশূন্যতা প্রতিরোধে বেশি পরিমাণে স্বাভাবিক পানীয় পান করা উচিত। পাশাপাশি নিয়মিত হাত ধোয়া, সর্দি-কাশি ও ফ্লুর প্রাদুর্ভাবের সময়ে ভিড়ের মধ্যে না যাওয়া, আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে না যাওয়া ইত্যাদি।