অটিস্টিক

অটিস্টিক শিশু – শিশুর সমস্যা

আমাদের আশেপাশে হয়তো আমরা এমন কিছু শিশু কখনও দেখে থাকি যারা নিজের ভেতর গুটিয়ে থাকে, সামাজিকভাবে আর দশটা শিশুর মত বেড়ে উঠেনা এবং আচরণগত অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। এ ধরণের রোগ লণ থাকলে তাকে বলা হয় অটিজম। অটিজম এক ধরণের রোগ আর যেসব শিশু এ রোগে আক্রান্ত হয় তাদের বলা হয় অটিস্টিক শিশু। শিশু অবস্থাতেই এ রোগ লণ প্রকাশ পায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিশুর বয়স ৩ বছর হবার আগেই অটিজমের লণ গুলো প্রকাশ পায়।

 অটিস্টিক

অটিজমে আক্রান্ত শিশুর সমস্যা বা লক্ষণগুলো বুঝতে তাই অভিভাবকদের হতে হবে অনেক সচেতন।

  • অটিস্টিক শিশুরা সামাজিক সম্পর্ক তৈরি করতে এবং সঠিক আচরণ করতে ব্যর্থ হয়। তাকে নির্দিষ্ট সামাজিক পরিস্থিতিতে প্রত্যাশিত আচরণের শিক্ষা দিতে হবে নিয়মিত। খেলার মাঝে সঙ্গীকে পড়ে যেতে দেখে শিশু হেসে উঠলে তার মানে এই নয় যে সে এটাকে মজার বিষয় বলে মনে করছে। হতে পারে, সে জানেই না এই সময়ে তার কী ধরনের আচরণ করা উচিত।
  • অটিস্টিক শিশুর সংবেদী ক্ষমতা অনেক সময় ভালো থাকে না। উ ৎ সবে বা বাজারে যেখানে শত শত মানুষ একসঙ্গে কথা বলছে, লাউডস্পিকার বাজছে জোর শব্দে—তার কাছে নরকতুল্য অভিজ্ঞতা হতে পারে, কেননা সে হয়তো অতি শ্রবণসংবেদী।
  • অনেক সময় কথার আক্ষরিক অর্থটাই বোঝে। অন্য অর্থ থাকলেও তা ধরতে পারে না। অটিস্টিক শিশুদের সঙ্গে বাগধারা, প্রবচন, প্রহসন, দ্ব্যর্থবোধক শব্দ ব্যবহার না করে সরাসরি সহজ ভাষায় কথা বলাই ভালো।
  • অন্যের কথা বোঝা ও নিজের মনের ভাব প্রকাশ করা—দুটোই অটিস্টিক শিশুর জন্য কঠিন। সে কথা শুনতে পায়, কিন্তু সরাসরি যদি তাকে না বলা হয় অথবা পুরোটা না বলা হয়, তাহলে তার অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে অনেক সময় সমস্যা হয়।
  • অন্যের সঙ্গে তুলনা করেই আপনার শিশুটি অটিস্টিক ভেবে বিভ্রান্ত হবেন না। প্রয়োজনে মনোরোগবিদ বা শিশুবিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। l জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট।

অনেক শিশু আছে যারা অটিজমে আক্রান্ত। মূলত এটি স্নায়ুগত সমস্যা। এ সমস্যাকে ইংরেজিতে নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার বলে। অটিজমের প্রকাশ শিশুর আচরণের মধ্যে ধরা পড়ে। সাধারণত শিশুর বয়স তিন বছর হওয়ার আগেই তার এই লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়।

অটিস্টিক শিশু – শিশুর সমস্যা

একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতাপূর্ণ মনোভাব, অতিরিক্ত খাওয়া-দাওয়া ও আদর, ছেলেমেয়ের স্বেচ্ছাচারিতা, প্রতিটি কাজে অতিরিক্ত সহযোগিতা, খুব ছোটবেলা থেকেই কোচিং, প্রাইভেট টিউটর, বাসায় একাধিকবার জোর করে পড়তে বসানো ইত্যাদি কারণে আমাদের সন্তানরা বড় হচ্ছে স্বল্প বুদ্ধি, স্বল্প আত্মবিশ্বাস, সাহসিকতার অভাব, আত্মকেন্দ্রিকতা এবং অধিকমাত্রায় মা-বাবার ওপর নির্ভরশীলতা নিয়ে। সকল ছেলেমেয়েই যে এইভাবে বেড়ে উঠছে তা নয়। এর পুরোটাই নির্ভর করে মা-বাবা বা পরিবারের অন্যান্য অভিভাবকের আচার-আচরণের ওপর। প্রত্যেক শিশুকে তার নিজের মতো করে পরিবেশ দিতে হবে। তাকে চেষ্টা করার সুযোগ দিতে হবে, আবিষ্কার করার মতো পরিবেশ দিতে হবে, নিজের সুপ্ত প্রতিভাকে প্রকাশ করার সুযোগ দিতে হবে, যথার্থ দিক নির্দেশনা দিতে হবে, পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে, তার সঙ্গে কাজে অংশগ্রহণ করতে হবে, বন্ধুদের সঙ্গে খেলা ও কাজ করার সুযোগ দিতে হবে, শিশুর মনের মধ্যে আগ্রহ জন্মাতে হবে, প্রতিটি কাজে আগ্রহী করে তুলতে হবে ইত্যাদি। শিশুর আচরণ খুব ভালো করে অবলোকন করতে হবে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।

ছেলে আমার অনেক বড় হবে, সমাজের একজন যোগ্য মানুষ হবে। একটি দামি সার্টিফিকেট ও ভালো চাকরির প্রত্যাশায় আমরা অনেকেই আমাদের সন্তানদের ভালো কোনো স্কুলে ভর্তি করাতে সচেষ্ট থাকি। কিন্তু অটিস্টিক শিশু বা অন্যান্য বিশেষ শিশুর বেলায় আমরা অনেকেই মনে করি তাদের পেছনে অর্থ ব্যয় অনর্থক। অনেক পরিবারে এর ব্যতিক্রমও দেখা যায়। আমাদের সমাজে অটিজম, মনোযোগে সমস্যা, চঞ্চল প্রকৃতি বা বিশেষ শিশুদের স্বাভাবিক ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য অনেক মা-বাবাই ব্যাকুল থাকেন। এতে করে আমরা যেমন অনেক টাকা নষ্ট করি, তেমনি নিজেরাও অনেক গৌরব বোধ করি। কিন্তু তাদের কী ক্ষতি করছি তা কি কখনো ভেবে দেখেছি? বিশেষ সমস্যাগ্রস্ত শিশুদের স্বাভাবিক ও ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি করানোর পর এরকম অনেক বাচ্চা দেখা গেছে যে, পিতামাতা ২-৩ বছর পর এসে বলছে বাচ্চার কোনো উন্নতি হচ্ছে না এবং আগের চেয়ে অনেক বেশি অস্থির হয়ে গেছে ও অনেক অস্বাভাবিক আচরণ দেখা যাচ্ছে। এর জন্য দায়ী কে? বাবা-মা না আমাদের সুধিসমাজ বা ডাক্তারগণ, যারা বিশেষ সমস্যাগ্রস্ত শিশুকে নরমাল বা নামকরা কোনো স্কুলে ভর্তির জন্য পরামর্শ দিয়েছিলেন। শিশু অনুকরণের মাধ্যমে যেমন বেশি শেখে তেমনি আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এই অনুকরণের জন্য শিশুর ব্রেনের কিছু ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন, যা শিশুকে শিখতে সাহায্য করবে। বিশেষ শিশুদের যদি এইসব ক্ষমতা থাকতো তাহলে তারা ছোটবেলা থেকেই সাধারণ নিয়মেই অন্যান্য শিশুর মতো শিখতে পারতো। স্কুলে একজন শিশু শিখতে পারে দেখে, শুনে, নিজেকে অন্তর্ভুক্তি ও অনুভবের মাধ্যমে। কিন্তু স্বাভাবিক পরিবেশ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হলে শিশুকে আগে কিছু গুণের অধিকারী হতে হবে, যেমন মনোযোগ, স্থিরতা, মনোভাব প্রকাশের ক্ষমতা, সমস্যা সমাধানের কৌশল, নির্দেশ অনুসরণ করার দক্ষতা ইত্যাদি। যে শিশু অস্থির, মনোযোগ নেই, অনুভূতি দিয়ে বুঝতে সমস্যা, মনোভাব প্রকাশ করতে পারছে না, সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে খেলতে পারছে না তার জন্য একটি বিশেষ চিকিত্সাভিত্তিক স্কুলের বিকল্প নেই। যেখানে বিশেষ শিশুর মনোযোগ, স্থিরতা, অনুভূতি, বুদ্ধিমত্তার কিছুটা বিকাশ ঘটিয়ে নরমাল বা ইনক্লুসিভ স্কুল ও সমাজে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

এখন পর্যন্ত অটিজম আক্রান্ত শিশুদের প্রতি সমাজে আছে বৈষম্য। তাদের প্রতি সহযোগিতা ও সচেতনতার হাত প্রসারিত করতে ০২ এপ্রিল সারা পৃথিবীতে ‘বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস’ পালন করা হয়। বাংলাদেশ সরকারও যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালন করেছে। দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল _ ‘অটিজম সচেতনতা বৃদ্ধিতে আমরা সবাই’। অটিজম আক্রান্ত শিশুদের সহযোগিতায় সরকার ইতোমধ্যেই কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন ২০১৩ প্রণীত হয়েছে। এছাড়া প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ প্রণয়ন করা হয়েছে। নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষা ও সমাজে অন্যদের সাথে সমতার ভিত্তিতে তার পূর্ণ ও কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছে। অটিজমসহ অন্যান্য প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা উপবৃত্তি প্রদান, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী স্কুল স্থাপন, ঢাকার মিরপুরে জাতীয় বিশেষ শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন, সরকারি চাকুরিতে কোটা সংরক্ষণ এবং ৬৪ জেলায় ৬৮টি প্রতিবন্ধী সেবা, সাহায্য ও অটিজম রিসোর্স সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। দেশব্যাপী অটিজম আক্রান্ত শিশুদের শনাক্তকরণের প্রক্রিয়া চলছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ন্যাশনাল ডিজ্যাবিলিটি ডাটাবেইজ তৈরি করার জন্য বাড়ি বাড়ি ঘুরে এ জরিপ কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।

আজ আপনি মেয়েশিশুদের বিয়ে না হওয়ার ভয়ে তার সমস্যা প্রকাশ করছেন না, কিন্তু এতে তার ভালো হওয়া বা স্বাভাবিক সমাজে প্রবেশ করার সুযোগ থেকে তাকে বঞ্চিত করছেন সারা জীবনের জন্য। আমাদের সমাজেরও আপনার শিশুর ওপর একটা দায়িত্ব ছিল, আপনি সমাজকে তার দায়িত্ব পালন থেকেও বিরত রাখলেন। বিশেষ একটি শিশুর জন্য বিশেষ স্কুলের বিকল্প নেই। এতে আপনার সম্মান নষ্ট হবে না বরং আত্মঅহংকারের গ্লানি থেকে আপনাকে রক্ষা করবে। শিক্ষা একজন শিশুর জন্মগত নাগরিক অধিকার। এ অধিকারের ভিত্তিতে যদি আমরা একজন বিশেষ শিশুকেও একজন স্বাভাবিক শিশুর মতো চিকিত্সাভিত্তিক স্কুলের মাধ্যমে সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিতে পারি তাহলে সেও হতে পারে স্বাবলম্বী এবং স্বাধীনচেতা নাগরিক। আর তা না হলে সে সারা জীবন অন্যের বোঝা হয়ে থাকবে।

মো. জহির উদ্দিন আকন্দ

ঢাকা


Discover more from Health Bangla

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Leave a ReplyCancel reply

error: Content is protected !!

Discover more from Health Bangla

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Exit mobile version