একটোপিক প্রেগন্যান্সি
নিষিক্ত ডিম্বানু জরায়ুর ভেতরে বিকাশ লাভ করে। কিন্তু দুই শতাংশ ক্ষেত্রে এই নিষিক্তকরণ জরায়ুর বাইরে ঘটে। ডিম্বনালী, ডিম্বাশয়, জরায়ুর আশে পাশে যদি গর্ভসঞ্চার হয় তবে তাকে একটোপিক প্রেগন্যান্সি বলে। এ ধরনের গর্ভাবস্থার সবচেয়ে বড় বিপদ হছে হঠাত্ ডিম্বনালী ফেটে গিয়ে পেটের ভিতরে তীব্র রক্তক্ষরণ। এরকম হয়ে সঠিক ডায়াগনসিস এবং চিকিত্সা না হলে মৃত্যু ঘটাও অসম্ভব নয়।

একটোপিক মানে নিধারিত স্থানের বাইরে। সাধারনভাবে নিষিক্ত ডিম্বানু ফ্যালোপিয়ান টিউব থেকে ৪/৫ দিনের মাথায় ইউটেরাসে চলে আসে ও তার গাত্রে লেগে যায়। এখানেই সে বাদবাকী ৪০ সপ্তাহ বসবাস করে। এরপর জরায়ুপথে মানবশিশু আকারে পৃথিবীতে আসে। প্রকৃতির বিচিত্র খেয়ালে তথা আল্লাহর ইচ্ছায় মাঝে মধ্যে (১%) কোন কোন মায়ের সাধারন স্থানের বাইরে নিষিক্ত ডিম্ব অবস্থান করতে পারে। এটাই একটোপিক প্রেগন্যান্সি।
চার রকম একটোপিক হতে পারে ১) ফ্যালোপিয়ান টিউবেই নিষিক্ত ডিম্ব বর্ধিত হওয়া (৯৫%) ২) ওভারীতে, ৩) টিউব ভেদ করে পেটে ও ৪) ইউটেরাস পেরিয়ে সার্ভিক্সে নীচের চিত্র দেখলে ব্যাপারটা ক্লিয়ার হবে।

যেখানেই হোক, একটোপিক ভয়াবহ। যেমন, টিউবে কনসেপশনের ১ সপ্তাহের মাথায় তা বিস্ফোরিত হয়ে মারাত্মক ইন্টারনাল ব্লিডিং হবে এবং রোগী শকে চলে যাবে। তাৎক্ষনিকভাবে তার সার্জারি ও ব্লাড রিফিল না করতে পারলে প্রাণ বাঁচানো মুশকিল।
একটোপিক প্রেগন্যান্সির কারণ
কেন একটোপিক প্রেগন্যান্সি হয় তার বিভিন্ন ব্যাখ্যা আছে। ডিম্বনালী যদি স্বাভাবিক না থাকে তবে এমনটি হতে পারে। আবার কোন নারীর যদি একবার একটোপিক প্রেগন্যান্সি হয় তা হলে ভবিষ্যতে আবার হবার সম্ভাবনা থাকে। গর্ভপাত করা হয়েছে এমন মহিলাদের এধরনের গর্ভাবস্থা হবার সম্ভাবনা বেশী। এন্ডোমেট্রিওসিস, সংক্রমণ, ধূমপান, গর্ভধারণের ওষুধ গ্রহণ ইত্যাদি কারণেও এ ধরণের অস্বাভাবিক গর্ভধারণ হয়। কিছু অবস্থা একটোপিক প্রেগন্যান্সির ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। যেমন- ১. বয়স ৩৫ এর বেশী হলে ২. অনেক যৌনসঙ্গী থাকলে ৩. ডিম্বনালীতে সার্জারি হলে ৪. জন্ম নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা IUCD গ্রহণ করলে ৫. পেটের অপারেশন যেমন এপেনডিসেকটোমি অপারেশনের পরে ৬. দীর্ঘদিন বন্ধ্যাত্বের ইতিহাস থাকলে
একটোপিক প্রেগন্যান্সির রোগ লক্ষণ
স্বাভাবিক গর্ভধারণের বিভিন্ন লক্ষণ একটোপিক প্রেগন্যান্সিতেও থাকে। মাসিক বন্ধ হওয়া, ক্লান্তি, বমিভাব, বমি, স্তনে ব্যথা, তলপেট ভারী, কোষ্ঠকাঠিন্য, বারবার প্রস্রাব ইত্যাদি লক্ষণ স্বাভাবিক গর্ভাবস্থায় থাকে। আবার একটোপিক প্রেগন্যান্সিতেও থাকে। তাই অনেক সময় একটোপিক প্রেগন্যান্সি ধরা কঠিন হয়ে পড়ে। সময় যত যেতে থাকে তত জটিল দিকে এ ধরণের গর্ভাবস্থা যেতে থাকে। যদি প্রথম দিকে জটিলতা সৃষ্টি না করে তবে অনেক সময় ডায়াগনসিস করা মুশকিল হয়। অস্বাভাবিক স্থানে গর্ভফুল বা প্ল্যাসেন্টা বড় হতে থাকলে একসময় টিস্যু ছিড়ে রক্তপাত হয়। অনেক সময় এত বেশী রক্তপাত হয় যে রোগী শকে চলে যায়। তখন রোগী অস্বাভাবিক ঘামতে থাকে, ফ্যাকাশে হয়ে যায় এবং রক্তচাপ কমে আসে।
চিকিত্সা না হলে রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। অনেক সময় তলপেট তীব্র ব্যথা হয়। কিছু ক্ষেত্রে যৌনিপথে সামান্য রক্ত যাওয়ার পর তলপেটে তীব্র ব্যথা দেখা দিয়ে থাকে।
একটোপিকের ভয়াবহতা হল এর খুবই অস্পস্ঠ লক্ষন। তলপেটে হালকা ব্যাথা কিন্তু আল্ট্রাসনোতে কিছুই ধরা পড়েনা। অনেক সময় মা টোটালি অনবগত যে তিনি কনসিভ করেছেন। গ্যাস্ট্রিকের ব্যাথা বা মাসিকের ব্যাথা বলে ডাক্তারেরা প্রেসক্রাইব করেন। হরমোন টেস্টে কনসিভ পজেটিভ আসতেও কয়েকদিন সময় লাগে। ইত্যবসরেই পরিস্থিতি জটিল হতে থাকে। আবার, কনসিভ টের পেলেও ব্যাথাকে গুরুত্ব দেয়ার পর্যায়ে আসতে আসতে একটোপিক কনসেপশন রাপচার হতে পারে।
মা হওয়ার কস্টসাধ্য যাত্রাপথে ঝুঁকির বিবেচনায় এটাই প্রথম বড় বাধা। আমেরিকাতে প্রথম ট্রাইমেস্টারে ম্যটারনাল ডেথের এটা বৃহত্তম কারণ। বোধকরি পরিসংখ্যানহীন বাংলাদেশেও তাই হবে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে রোগীর রাপচার হলে পরে, হাসপাতালে নেয়ার পথেই হেমোরিজেতে মারা যাবে। এবং দক্ষ গাইনী বিশেষজ্ঞ পেতে পেতে…!
একটোপিক প্রেগন্যান্সি আগেভাগে টের পেলে
একজন মহিলা গর্ভবর্তী এবং তার তলপেটে তীব্র ব্যথা হচ্ছে সাথে যৌনিপথে রক্তক্ষরনে একটোপিক প্রেগন্যান্সির কথা মাথায় রাখা উচিত। আল্ট্রাসনোগ্রাফি করলে সহজেই রোগটি ধরা পড়ে। ডিম্বনালীতে “জেস্টেশেনাল স্যাক” এবং ফিটাসের হূদস্পন্দন বোঝা গেলে নিশ্চিতভাবেই ডায়াগনসিস করা যায়। কারণ ৯৮ ভাগ ক্ষেত্রে ডিম্বনালীতেই অস্বাভাবিক গর্ভসঞ্চার হয়। হরমোন পরীক্ষা করলে বিটা হিউম্যান কোরিওনিক গোনাডোট্রপিন হরমোন রক্তে বেশী পাওয়া যায়।
একটোপিক প্রেগন্যান্সি প্রতিরোধ
একটোপিক প্রেগন্যান্সির সঠিক কারণ আজো জানা যায়নি। তবে অনেক কারণ বের করা হয়েছে যার সাথে রোগটি সম্পর্কিত। এসব কারণ দূর করতে পারলে অনেকটাই একটোপিক প্রেগন্যান্সি প্রতিরোধ করা যায়। যেমন-
১. একাধিক যৌনসঙ্গী বর্জন করতে হবে
২. ধূমপান, এলকোহল বর্জন করতে হবে
৩. তলপেটে ইনফেকশন থাকলে চিকিত্সা করা উচিত। আজকাল অনেক ভালো এন্টিবায়োটিক পাওয়া যায়
৪. বেশী বয়সে বাচ্চা নেওয়া উচিত নয়। এর ফলে অনেক জটিলতা সহ একটোপিক প্রেগন্যান্সি হতে পারে।
৫. গর্ভপাত করালে একটোপিক প্রেগন্যান্সির সম্ভাবনা বেড়ে যায়। D&C এবং MR করলে ভবিষ্যতে এ রোগ হবার সম্ভাবনা বেশী থাকে। তাই এসব থেকে দূরে থাকতে হবে।
৬. গর্ভাবস্থার আগে বা গর্ভাবস্থায় চিকিত্সকের পরামর্শ ছাড়া কোন ওষুধ খাওয়া ঠিক নয়
৭. যেকোন অপারেশন দক্ষ সার্জনের কাছে করা উচিত
৮. গর্ভাবস্থায় প্রথম দিকে একবার আল্ট্রোসনোগ্রাফি অবশ্যই করা উচিত।
তাহলে আগে থেকেই রোগটি ধরা যায় এবং ভাল চিকিত্সা করা সম্ভব হয় একটোপিক প্রেগন্যান্সির যদি সঠিক ডায়াগনসিস এবং চিকিত্সা হয় তবে মৃত্যুহার খুবই কম। কিন্তু উন্নত দেশের মত সুযোগ সুবিধা আমাদের দেশে নেই। আশার কথা বর্তমানে দক্ষ চিকিত্সকের সংখ্যা বাড়ছে। আজকাল গ্রামে গঞ্জেও আল্ট্রাসনোগ্রাফির ব্যবস্থা আছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে এমবিবিএস চিকিত্সক কাজ করছেন। শিক্ষার হার এবং স্বাস্থ্য সচেতনতাও বাড়ছে। একটোপিক প্রেগন্যান্সি নিয়ে সবার সচেতনতা দরকার। না হলে অসাবধানতা এবং অসচেতনতার জন্য ঝরে যেতে পারে অমূল্য প্রাণ।
রাপচারের আগে টের পেলে ওষুধ, লেপোরোস্কপি, সার্জারী যা প্রযোজ্য ডাক্তাররা করতে পারেন। তবে প্রায়শ: সংশ্লিস্ট টিউব কেটে ফেলতে হয়। এক্ষেত্রে মা ও পরিবারের মানসিক দৃঢ়তা আবশ্যক। আপাত:সুস্থ (হালকা ব্যাথা) রোগীর অঙ্গহানি মেনে নেয়া কঠিন।
মনে রাখবেন
কাংখিত/অনাকাংখিত/ইগনোরড প্রেগন্যান্সির আড়ালে একটোপিক লুকিয়ে থাকতে পারে অনিয়মিত মাসিক ও প্রথমবারের মত মা হতে ইচ্ছুকরা সবচেয়ে ভালনারেবল বিবাহিত মা হতে ইচ্ছুক (বা বায়োলজিক্যালি তেমনটি)দের তলপেটে ব্যাথা হলে নিছক গ্যাস্টিক, মাসিকের ব্যাথা ইত্যাদির পাশাপাশি ভেবে দেখুন এক দেড় সপ্তাহের মত কোন কনসেপশনের চান্স আছে কিনা।
চান্স থাকলে দ্রুত ভালো গাইনোকোলজিস্টের শরনাপন্ন হন।
টিউবিক প্র্যাগনেন্সির ক্ষেত্রে সার্জারী করে টিউব ফেলে দেয়ার মত ব্যাপার হলে ধৈর্য্যধারন করে সায় দিন। নচেৎ আরো বড় ক্ষতি হবে।
অনেক ব্যাথা, ঠোঁট, চেহারা, চোখ ও চামড়া সাদা হয়ে প্রায় মরণাপন্ন হয়ে যাওয়ার অর্থ হল একটোপিক রাপচার হয়ে ভেতরে প্রচুর রক্তক্ষরন হয়েছে। এক্ষুনি হাসপাতালে নিন।হবু মা/ মা রা আগেভাগে নিজের ও পরিচিতদের ব্লাড গ্রুপ জেনে রাখুন। এ ব্যাপারে সচেতন হোন।