আমলকি গাছ, তার আস্তিকতা অথবা রক্তপ্রবাহ – অদিতি ফাল্গুনী

জানালার সামনের এই আমলকি গাছটি যে পরম আস্তিক সে বিষয়ে মিথিলার কখনোই কোনো সন্দেহ হয় না। সকালের আলো না ফুটতেই হেমন্তের আধ ভেজা কুয়াশায় আলোর অকিঞ্চন পাখিরা উড়ে এসে বসে গাছটির ডালে। তার শীর্ণ পাতাগুলো ঝরার কাল চলে এল। একেই উষস সময় বলে যখন সারা রাত অনিদ্রার পর তার ঘুমের সময় হয়। এত বড় অস্ত্রোপচারের পরপর এমনটা নাকি রোগীদের হয়ই। নইলে এমনিতে মিথিলা সুখী মানুষ। সার্জারির আগ পর্যন্ত সারা দিন অফিস করে ফিরে, ফেসবুকে দেশ উদ্ধার করার পর রাত বারোটায় এক মগ কফি খেয়ে, পরক্ষণেই বালিশে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়তে তার কোনো কষ্ট হতো না।
আমলকি গাছ, তার আস্তিকতা অথবা রক্তপ্রবাহ
আমলকি গাছ, তার আস্তিকতা অথবা রক্তপ্রবাহ

আমলকি গাছ, তার আস্তিকতা অথবা রক্তপ্রবাহ – অদিতি ফাল্গুনী

-তু যে আজ ঘুমাছিস না? আতে (রাতে) ঘুমাছু?
কালো মুখে এক ঝিলিক হাসি নিয়ে বলত রীতা। রীতা মাহাতো। দিনাজপুরের কোন গ্রাম থেকে তাকে আনা হয়েছিল মিথিলা ভালো জানে না।
-এ্যাই তোক হাম দিদি ডাকিম না মাসী ডাকিম?
-মাসীই ডাকো।
-মাসী ডাকিম? এ ঘরের বড় মাসী তোক কী লাগে? তুর কী হয়?
-আমার দিদি।
-হামি ভাবিছু কি বড় মাসী তুর মা লাগে। তুর মা লাই?
-না।
-বাপ লাই?
-না।
-মুরিশে?

 

অনেক কষ্টে মিথিলা বুঝেছিল মুরিশে অর্থ বোধ করি মারা গেছে। কাজেই ঘাড় নাড়লে রীতা মাহাতো আবার হেসেছিল।
-মোর মা হামাক ফেলিয়া বিয়া করিছু। বাপে হামাক ফেলিয়া আর এক জায়গায় বিয়া করিছু। মোক দেখিবার কেউ লাই। ই মাসী—তু ইখন ঘুমাবি? আতে ঘুমাছ লাকেনে?
জানালার সামনে নিশ্চুপ খানিকক্ষণ একা একা কাটিয়ে শয্যায় ফিরত তখন মিথিলা।

 

-তু ঘুমা। সবাই অফিস গেছে। তোর যি বেলা ভুখা নাগিবে সি বেলা হামাক ডাক দিবি। হামি তোক খাবার দিব। বড় মাসী মোক কয়্যা গেছে তুকে খাবার দিতে। নয় উ মোক বকা দিব।

 

সপ্তাহ দুয়েক হয় রীতা গ্রামে গেছে। আর ফিরবে না।

 

-তু জানিস মাসী হামাদের গ্রামে অসুর পূজা হয়?

 

-অসুর পূজা? মানে? এখন তো দুর্গা পূজার সময়?

 

-গ্রামের পাহান বুলে কি ওই যে দেবী দুর্গাটা অত ধলাটা আছে লা, সে নাকি আগোত হামাদের মানে অসুরদের বিটি ছিল? পরে দেবতারা উহাকে লিয়া যাছে। উ তখন হামাদের রাজাকে মারিছে—হ!

 

বলে কী? ফেসবুকে পশ্চিম বাংলার মার্ক্সিস্টদের শেয়ার করা কিছু প্রবন্ধে সে এমনটা পড়ছে। তবে এমন পূজা তো বিহার বা ঝাড়খণ্ড এলাকার আদিবাসীদের ভেতর। বাংলাদেশের উত্তরের আদিবাসীরা যারা তারা  তো হিন্দু দেব-দেবীর পূজা করতেই আজ অভ্যস্ত। তবে? নাকি উত্তরের অনেক আদিবাসী গোত্রই তো সেই ব্রিটিশ আমলে ওই বিহার বা ঝাড়খণ্ড এলাকা থেকেই উত্তর বাংলায় বন-জঙ্গল সাফ করে আবাদের কাজে এসেছিল? তাদের অতীত পরম্পরা এখানে কারো কারো মাঝে বা কোনো কোনো গ্রামে কি আজো বয়ে চলেছে? কে জানে! মিথিলা এখন এত অসুস্থ যে এসব তদন্ত করতে যাবার অবস্থা তার নেই।

 

-তোরা কোথা থেকে এসেছিস রে রীতা জানিস?

 

-কুথা থেকে আবার আসিব? অত কথা হামি কুবার পারি লা। তুকে কি দিব ইখন? চা লা কুফি?

 

-কফি দে।

 

তা রীতা মাহাতোকে চলে যেতে হলো। রীতার মা-র নতুন ঘরে যমজ বাচ্চা হয়েছে। কিশোরী মেয়েকে তার আবার ঘর সামলাতে দরকার। এখন সাত সকাল থেকেই বাসায় কেউ থাকে না। ফিরতে সবার সন্ধ্যা। কাজেই রাতে ঘুম হোক আর না হোক সকালটা সে জেগে থাকে বাড়ির সবার কাজে বের হবার জন্য। তারপর সন্ধ্যা অবধি গোটা ঘরে সে একা। এখন তার ক্ষমতা হয়েছে ঘরের দরজা পর্যন্ত গিয়ে দরজা আটকানো, একা একা লম্বা, টানা বারান্দায় ঘোরা-ফেরা কি কিচেনে গিয়ে এক কাপ চা বা কফি নিজেই বানিয়ে নেবার। তবে বাসার বাইরে বের হবার অনুমতি সে এখনো পায়নি। দিল্লিতে যেতে তাদের একটু দেরি হয়েছিল। কাজেই সার্জন বললেন এই সার্জারিতেই ধকল শেষ হবার নয়। আরো তিন কি ছ-মাস পর আবার একটি করিয়ে নিলে সে পুরো সেরে যাবে। যে সমস্যার সাথে সে লড়াই করছে গত দুইটি দশক। কিন্তু সার্জারি তো শুধু সার্জারি নয়। অ্যানেস্থেশিয়া (Anesthesia) দিয়ে অপারেশন থিয়েটারের বেডে কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে থাকা তো শুধু না। ঘুম ফিরলে পোস্ট অপারেটিভে চোখ খুলে মুখের উপর উদ্বিগ্ন ভারতীয় নার্সের তাকিয়ে থাকা, সদয় নার্সের চামচে করে এক চা-চামচ জল মুখে দিলে তার চোখ বেয়ে গড়িয়ে এসেছিল তপ্ত অশ্রু এই সহূদয়তায়…তারপর ঘণ্টা দেড়েক পোস্ট-অপারেটিভে একটি কৃত্রিম যন্ত্র খানিক পর পর তার প্রেশার আর পালস্ মাপে—প্রেশার আর হাই কি হবে? সে আজীবন লো প্রেশারের রোগী…ঘণ্টা দেড়েক পর হাসপাতালের স্ট্রেচারে করে তাকে বেডে দেয়া হয় যেখানে উদ্বিগ্ন, পাঙশু মুখে রয়েছে দুই বড় ভাই-বোন…তারপর ভারতীয় সেবিকারা…তারা কেউ মেঘালয়ের হরিদ্রাবর্ণা রূপসী আর কেউ বা দক্ষিণের শ্যামশ্রী…তাকে একটু পর পর নারকেল জল বা ফলের জুস দিয়ে যায়…সে এক চামচ খেয়েই বমি করতে থাকে…পরবর্তী সাত দিন সে কোনো কঠিন খাদ্যবস্তু গ্রহণ করে না বোধ করি একরকম জেদেই…শয্যায় সে শৌচ করবে না…এবং এমতো প্রতিজ্ঞায় সে একরকম সফল হয়…ডাক্তার খুব রেগে যান রোগীর এমন জেদে—টাকা দিয়ে রাখা আয়াকে দিয়ে নারকীয় কাজ করাবে না বলে সাত দিন প্রায় কিছু না খেয়ে জেদ করে পড়ে থাকার আহাম্মুকিতে ডাক্তার প্রচণ্ড বিরক্ত হন—ধীরে ধীরে হুইল চেয়ার, তারপর সাপোর্ট নিয়ে দণ্ডায়মান হতে পারা…সার্জারি এমন একটি গোটা প্রক্রিয়া…তেমন দণ্ডভোগ এক বছরের ভেতর দু-দু’বার? যদি বা মিথিলার জীবনের বেশ বড় কিছু সময় কেটেছে রোগশয্যায়, রোগশয্যা নিয়ে সে কখনো পিছু তাকায়নি…মুহূর্তের জন্য মনে করতে চায়নি হাসপাতালের বিচিত্র, মর্মন্তুদ সব অভিজ্ঞতা—কিন্তু, এবার বয়স হচ্ছে বলেই কিনা কে জানে হাসপাতাল তাকে পিছু ছাড়ছে না? যদি ভুলে যেতে হয় ঐসব ক্যাথিটার নল, হাতে ক্যানোলায় ভরতে থাকা স্যালাইন ড্রিপ (Saline Drip), দিল্লির ইন্দ্রপ্রস্থ অ্যাপোলোর সেই সব ফুটফুটে নেপালি বা উত্তর প্রদেশের তরুণী আয়াদের যাদের হাতের তালু খসখসে হয়ে যাচ্ছে বৃদ্ধা রোগিনীদের রাতভর বেড প্যান পরিষ্কার করার কাজে…তবে সকালের এই আমলকি গাছের আনত, নম্র পাতার দিকে তাকিয়েই গত দু’মাস তার মনে ভরে উঠেছে পরম ভরসা আর আশ্বাসে। সেইহেতু মিথিলার অনিবার্য বিশ্বাস হয়েছিল যে এই আমলকি গাছটি আস্তিক। যে ফলবান হতে জানে গর্ভবতী নারীর মতোই যদিচ মিথিলা আজ অবধি অবিবাহিত এবং তাই কখনোই গর্ভবতী হয়নি…হয়তো সেজন্যই নিজেকে মিথিলা আস্তিক বলে দাবি করতে পারে না—আহ্ নেতি আহ্ নৈরাশ্য আহ্ নৈরাজ্য তুমি সদা প্রভু কি? জেরুজালেমের মেষপালক বা আরবের সেই সত্যবাদী যুবা কি তুমি হে নেতি হে নৈরাশ্য? চূড়ান্ত নেতির ঈশ্বর কে হতে পারে? বিপরীতে ইতিবাচকতা, বিপ্রতীপে সদর্থকতা। আশা-উদ্যম-কাজ। সকাল বেলায় তানপুরায় ভৈরব কিম্বা তোড়ি। তোড়িই ভালো : অব মোহে পার করো করো পার—তুম জগকে পালন হার! আর এই আকাশগঙ্গা প্রতি রাতে অনন্ত জ্যোতিশ্চক্রের নক্ষত্রবলয়ে পরিপূর্ণ হয়—তা’ কি পরম আস্তিকতা নয়? হে প্রভূ—পরম পিতার নামে—ঈশ্বরপুত্রের নামে—অলিম্পাসের দেবতাগণের নামে—জিহোভার নামে—অহুর মজদার নামে—আমি নতজানু…আমাকে মার্গ বলো…যেখানে এই আমলকি গাছ প্রকৃত আস্তিক—আস্তিকতা আমি গ্রন্থের পাতায় কেন সন্ধান করব? আস্তিকতা পাবে তুমি পৌষের সরষে ক্ষেতে, ময় ময় ধানের গন্ধে আর এমনকি জানালার পাশের এই আমলকি গাছের পাতায় যেখানে অকিঞ্চন আলোর পাখিরা প্রতিদিন উষস সকালে উড়ে এসে বসে। যা কিছু অস্তিত্ববান তাই কি আস্তিক বা আস্তিকতা নয়? যেমন আমলকি গাছে পুরুষ্টু ফল ধরা…তারা কোমল এবং বিনম্র…হেমন্তের শেষে আমলকি গাছের পাতা ঝরা শুরু হবে…এখনো পাতাগুলো আছে যার দিকে তাকিয়ে সে প্রতি ভোরে বিনিদ্র রাতের যন্ত্রণা ভোলে, ভোলে দুই ঊরুতেই কোমরের কাছ থেকে ঊরু অবধি শল্যবিদের টেনে দেয়া দীর্ঘ, উজ্জ্বল দুটো অনশ্বর দাগের কথা…এই যে গাছ শোনো—মাথা দুলিয়ে আমাকে উপেক্ষা করো না হে তরুরাজ—আমি তোমার মতো বিশ্বাসী আর সদর্থক হতে চাই—জীবনের প্রতি—ফলবান এবং ভরন্ত, নত আর বিনম্র—কোনো দুঃখ বা মলিনতা যেন আমাকে স্পর্শ না করে—আমি তোমাকে দেখে বিশ্বাসী হতে শিখি—আমি তোমাকে দেখে রবীন্দ্র সংগীত হতে শিখি—রাগ ভূপকল্যাণ হতে শিখি—বাজো রে বাজো মন্দোরোলা, সুঘর সুঘর নর-নারী…অথচ, আজ দু’দিন হয় স্পষ্টতঃ এই আমলকি গাছের পাতাগুলো পর্যন্ত ভিজে উঠেছে রক্তে। আর কেউ দেখতে না পাক মিথিলা ঠিকই দেখতে পাচ্ছে। তবে, বাড়ির কাউকেই সে এটা বলছে না। বললে যদি কেউ তাকে বিশ্বাস না করে? যদি সবাই ভাবে দীর্ঘ দিন ধরে একা বাসায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা থাকতে থাকতে মিথিলার মনোবৈকল্য দেখা দিচ্ছে? শারীরিক অসুস্থতা সারাতে গিয়ে তার দেখা দিচ্ছে মনোরোগ? তবে আর দেখতে হবে না! দ্য বার্থ অফ ক্লিনিক, ম্যাডনেস অ্যান্ড সিভিলাইজেশন, দ্য বার্থ অফ প্রিজন (The Birth of Prison) —হাসপাতালের রোগী অস্পৃশ্য আর ঘৃণার্হ জেলের কয়েদির মতোই। যে ক-দিন হাসপাতালে থাকে রোগী, তাকে পরতে হয় ভিন্ন জামা-কাপড়। সে কয়েদিদের মতোই। তার থালা-গ্লাস আলাদা। জীবনে প্রথম যখন সে অসুস্থ হয়েছিল…অষ্টাদশী তখন…ফুসফুসের অসুখ সেরে গিয়ে পরের দুটো দশক সেই ট্রিটমেন্টের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মিথিলা সয়ে গেল দুই পায়ে…অথচ আট বছর বয়সে ছয় মাইল পায়ে চলে বনভোজনে ছুটতে থাকা মিথিলা…সেই ফুসফুসের অসুখে তার কাশির সাথে বের হতো উজ্জ্বল যত রক্তকরবীর গুচ্ছ…তখন তার থালা-গ্লাস সব আলাদা হয়ে গেল কিছুদিন…বাসা আর হাসপাতালে…তবু শারীরিক রোগীকে কেউ তত ভয় পায় না—হয়তো তাকে নিয়ে বিরক্ত বা ক্লান্ত হয় কেউ; শ্রান্ত হয় কেউ তার অক্ষমতা নিয়ে বা দীর্ঘ সেবা-শুশ্রুষার ক্লান্তিতে,  তবু শারীরিক রোগী বিপজ্জনক নয় মনোরোগীর মতো…কাজেই কাউকে বুঝতে দেয়া যাবে না যে গত দু-দিন হয় মিথিলা জানালার সামনের আমলকি গাছের পাতাগুলো দেখছে রক্তে থকথক করছে। টপটপ করে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে প্রতিটা পাতা থেকে। সে কি এ বাড়ির কেয়ারটেকারকে জানালা দিয়ে ডেকে বলবে? না, কেয়ারটেকার যদি তাকে পাগল ভাবে? অথচ মাস খানেক কি দেড়েক আগে কোরবানি হলো। নিচতলায় যারা কোরবানি দিল, পরের দিন সকালে জানালা থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে তখনো সে নিচের বারান্দায় শুকনো রক্তের দাগ দেখেছে—আর রক্ত মানে তো বিসর্জন? সুসঙ দূর্গাপুরে গতবছর গিয়ে সে দেখেছিল নবমীর সন্ধ্যায় মন্দিরের পাশে দড়িতে আটক কিছু ছাগশিশু—বলির জন্য দত্ত—ত্রিপুরার মহারাজা গোবিন্দ মাণিক্য বলির পরের সকালে তাই নদীঘাটে গিয়ে শুনতে পেলেন করুণাময়ী জগজ্জননী বালিকার রূপ নিয়ে বলছে, আয় তাতা—আমরা সব রক্ত ধুইয়া দিই! হাসির মতোই বুঝি জ্বর আসছে মিথিলার? অথচ তার আর গোটা জীবনে জ্বর হতে পারবে না। জ্বর হলেই খুব বিপদ। শরীরের ভেতর দুটো ক্ষয়ে যেতে থাকা হাড় ফেলে দুটো কৃত্রিম হাড় বসানো হয়েছে। বাকি জীবন যেকোনো সিক্যুরিটি চেকের সামনে তাকে ডাক্তারের কার্ড দেখাতে হবে। নয়তো মেটাল ডিক্টেটর টিক টিক করে উঠবে। সামনে আরো দুটো কৃত্রিম হাড় বসাতে হতে পারে। সে তো কৃত্রিম হাড়ে চলছে আর আগুনের রেণু ঝরছে—ইসশ্, কবিতার খাতা এখন ফেসবুকের নোটস—ভার্চুয়্যাল খাতা! না—মিথিলা—বাড়ির কাউকে বলো না যে আমলকির পাতায় রক্ত দেখছো। নাক টানছো কেন? গন্ধ লাগছে? কে খুন হলো? কে আবার? দীপ্ত খুন হয়েছে, না? প্রথম যেবার বই করল সে তোমার, একইসাথে পহেলা ফাল্গুন, বইমেলা আর বিশ্ববিদ্যালয় পাড়ায় সরস্বতী পূজার জেরে আজিজ মার্কেট থেকে জগন্নাথ হল অবধি অকথ্য জ্যাম। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার মতো বাজে। ভদ্র, হাসিমুখ দীপ্ত নিজেই নিচে নেমে এলো ছয় কপি বই নিয়ে। লেখককপি হিসেবে। তিনটি বই করেছিল সে তোমার। পর পর দুই/দুইটা ফেব্রুয়ারি দীপ্তর অফিসে টেবিলে টানা বসে কয়েকদিন প্রুফ কাটা, কাভার ডিজাইন। দীপ্ত ফ্রুট জুস আনায়, ফাস্ট ফুড কি লাল চা। উফ্…কেমন একটা রক্তের গন্ধে ভরে উঠছে চারপাশ। আর রাতুল—রাতুল তবে এযাত্রা সারভাইভ করল?

 

সে নিজে এ দৃশ্যের অংশ। পরের দৃশ্যগুলো সে পরম্পরা মেনে ভাবতে পারে না। শুধু দীপ্ত, রাতুল, হিমেল—তিন-তিন জন চেনা মানুষের অকথ্য রক্তের হল্কা মিথিলার মুখে এসে ঝাপটে পড়ে। মিথিলা ফেসবুক লগ আউট করতে চায়। পারে না। নেট এত স্লো আর এতটাই হ্যাঙ হয়ে আছে যে লগ আউট করা যায় না। মিথিলা গুটি গুটি পায়ে ডাইনিং রুমের টেবিল ছেড়ে শোবার ঘর হয়ে বাথরুমে ঢোকে। বেসিনে মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে বের হতে হতে কলিং বেল আসে। উদ্বিগ্ন মুষিকের স্নায়ু চমকে উঠতে চায়।

 

-কে? কে?

 

-ময়লা! ময়লা দিবেন আম্মা? বাসায় ময়লা আছে? বাইরে থেকে সিটি কর্পোরেশনের আবর্জনা সংগ্রাহক গলা তুলে বলে।

 

-যতক্ষণ আমরা কেউ বাসায় না ফিরি, ভুলে দরজা খুলবে না! বাড়ির আর সবার সতর্কতা বাণী কানে বাজতে থাকায় সে ময়লা দিতে যায় না। কাজেই রান্না ঘরে গোটা সপ্তাহ জুড়ে একাধিক বালতিতে জমতে থাকে ময়লা। লে ফ্লরস দ্যু মাল—নষ্ট শসা, কুমড়ো, চায়ের পাতা, রসুনের খোসা, তরকারির ঝোলের মরিচ—আর উইক-এন্ডে পরিষ্কার হবে! কেউ দরজা নক করছে? টিভিতে কী চলছে? চ্যানেল টিপতে শুরুতেই কেন জানি এসে গেল হিস্ট্রি চ্যানেল।

 

-মাসী— হো মাসী!

 

খসখসে গলায় রীতা ডাকছে নাকি তাকে? দিনাজপুরের এক গ্রামের সেই মাহাতো কিশোরী।

 

-সারাটা দিন উ গাছটোয় তাকায়া থাকিস কেনে? তু কি দেখিবার পাস উ গাছটোয়?

 

-কত পাখি আসে সকালবেলা দেখিস? আর পাতাগুলো দ্যাখ কত সবুজ! দেখলে মন ভালো হয়ে যায় না?

 

-তু আমলকি খাস? হামি ভালোবাসি আমলকি। হামাদের গিরামে অসুর পূজার সময়—সেই যে দুর্গা, হামাদের মেয়েটাকে দেবতারা লিয়া গেলো আর দুর্গা নিজের মানুষের রাজাটাক মারিলো— উ মহিষাসুর— তার পূজা করি হামরা— ই সময়টায় হামাদের গিরামে হামাদের বাড়ির কাছে একটো আমলকি গাছ আছে— ই গাছটোর চেয়ে বিশি ফল ধরে—হামরা উগুলান পাড়িবার পর খামো।

 

-কিভাবে পাড়বি রীতা? সব রক্ত ধরে গেছে দেখতে পাচ্ছিস না? রীতা?

 

কেউ সাড়া নেয় না। কেউ সাড়া নিচ্ছে না কেন? রীতা? রীতা? কী দুষ্টু মেয়ে রে—ডাকছি কতক্ষণ—শুনিস না কেন?

 

রীতা তো চলেই গেছিল তার গ্রামে অসুর পূজার উদ্যাপনে আর মিথিলার জানালার সামনের পরম আস্তিক আমলকি গাছটি ততক্ষণে রক্তধারায় অভিষিক্ত হতে থাকে।

Discover more from Health Bangla

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Leave a ReplyCancel reply

error: Content is protected !!

Discover more from Health Bangla

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Exit mobile version